বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:দুর্গাপুজো অনুদান মামলায় ফের কলকাতা হাইকোর্টের কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হল রাজ্য সরকারকে। শুধু তাই নয়, রাজ্যের উচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে যা বলছেন, তার সঙ্গে সরকারি নির্দেশিকার কোনও মিল নেই। বলা বাহুল্য, হাইকোর্টের এই মন্তব্যে রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। হাইকোর্টের এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে বিজেপি, সিপিএম–সহ বিরোধী দলগুলি।
শুক্রবার এই অনুদান মামলায় বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার নির্দেশ দেন, ‘ক্লাবগুলি যে অনুদানের টাকা পেয়েছে, তার ৭৫ শতাংশ খরচ করতে হবে স্বাস্থ্য খাতে। অর্থাৎ, মাস্ক, স্যানিটাইজার প্রভৃতি কোভিড কিট কিনে দর্শকদের মধ্যে বিলি করতে হবে। বাকি ২৫ শতাংশ টাকা খরচ করা যেতে পারে জনসংযোগ খাতে। কোনও বিনোদনমূলক কাজে অনুদানের টাকা খরচ করতে পারবে না ক্লাব বা পুজো কমিটিগুলি। সমস্ত খরচের বিস্তারিত হিসেব দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। আর রাজ্য সরকারের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল লক্ষ্মীপুজোর পর উচ্চ আদালতে হলফনামার আকারে সেই বিস্তারিত হিসেব জমা দেবেন।’ এখানেই থেমে যাননি বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘দুর্গাপুজোর কমিটিগুলিকে টাকা দেওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী যে কারণে টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন, আর পরে বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্য সরকার যে কথা বলছে, তা মিলছে না।’
শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বিচারপতি এদিন আরও বলেন, ‘দলমত নির্বিশেষে আমলাতন্ত্রের মেরুদণ্ডই ভেঙে দিয়েছেন আপনারা। এই অবস্থা হত না, যদি আমলাতন্ত্র মজবুত হত। বিচার, বুদ্ধি এবং বিবেচনায় আমলারা আপনাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’ এই মামলা নিয়ে সিআইটিইউ নেতা সৌরভ দত্তের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আদালতের কাছে আমাদের বক্তব্যের অন্যতম বিষয় ছিল, সরকারের অবস্থান বদল। আসলে মুখ্যমন্ত্রী মুখে যে কথা বলছেন, আর সরকার যে বিজ্ঞপ্তি জারি করছে, তা পুরোপুরি উল্টো। এদিন আদালতও একই কথা বলেছে।’ উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে প্রথমবার পুজো কমিটিগুলিকে ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া শুরু করে রাজ্য সরকার। ২০১৯ সালে সেই টাকার অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫ হাজার টাকা। এবার গতবারের তুলনায় তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিমাণ হয় ৫০ হাজার টাকা।
২০১৮ সালেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন এই সৌরভ দত্তই। তখন হাইকোর্টে রাজ্য সরকার বয়ান বদল করে জানিয়েছিল, ওই টাকা নাকি ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ প্রকল্পের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এবার সরকার জানিয়েছে, মাস্ক, স্যানিটাইজার কিনতে পুজো কমিটিগুলিকে টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে হাইকোর্ট ওই মামলায় স্থগিতাদেশ দেয়। পরে তা তুলে নেওয়া হয়। তার পর সৌরভ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন। এরই মধ্যে এ বছরও একই ইস্যুতে হাইকোর্টে ফের মামলা করেছেন সৌরভ দত্ত। এদিকে, হাওড়ার অজয়কুমার দে–র করা একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি অরিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে রাস্তাঘাট এবং পুজোমণ্ডপে ভিড় কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করেছে, তার একটি সম্পূর্ণ গাইডলাইন তৈরি করে আদালতকে জানাবে।
সোমবারের মধ্যে সেই গাইডলাইন তৈরি করে হাইকোর্টে জমা দেবেন মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব। ওই গাইডলাইন দেখেই উচ্চআদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। অজয়কুমার দে তাঁর জনস্বার্থ মামলায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, গোটা দেশেই যখন অতিমারি পরিস্থিতিতে বহু উৎসব–অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে, তখন বাংলায় দুর্গাপুজোর অনুমতি দেওয়া হল কেন? কেনই বা পুজো কমিটিগুলিকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে? এদিন উচ্চ আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘৫০ হাজার টাকার মাস্ক, স্যানিটাইজার লাগে না। রাজনীতিকে ধর্মে নিয়ে গিয়ে যে ভাবে ভোট পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। আদালতের নির্দেশ মেনে চলা উচিত রাজ্যের।’
সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘পুজোর অনুদান নিয়ে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তাতে পরিষ্কার মুখ্যমন্ত্রী অসত্য বলছেন। এর আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, কোভিড পরিস্থিতিতে পুজো কমিটিগুলি বিজ্ঞাপন পাবে না, তাই তাদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আর আদালতে সরকারের আইনজীবী বলেছেন, মাস্ক ও স্যানিটাইজার কেনার জন্য এই অনুদান দেওয়া হচ্ছে। সরকারি আইনজীবীর এই বয়ানেই সব প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।’